দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সদস্যভুক্ত ব্রোকারেজ হাউস বানকো সিকিউরিটিজের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে প্রায় ১২৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে নগদ ৬৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং শেয়ার বিক্রি করে আরও ৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এতে নগদ টাকা ও শেয়ার বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা ১২৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা অত্মসাৎ করেছেন। এ অভিযোগ আমলে নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আদালতে একটি মামলা দায়ের করে, যা এখনও বিচারাধীন।
ব্রোকারেজ হাউজটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বিক দিক বিবেচনা করে বানকো সিকিউরিটিজের সাতজন পরিচালককে মোট সাত কোটি টাকা অর্থদণ্ড করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা ও সিকিউরিটিজ বিধি-বিধান লঙ্ঘন করার অভিযোগে সম্প্রতি কমিশন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
অর্থদণ্ডিত ব্যক্তিরা হলেনÑবানকো সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান আব্দুল মুহিত, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামিউল ইসলাম, পরিচালক মো. শফিউল আজম, পরিচালক ওয়ালিউল হাসান চৌধুরী, পরিচালক নুরুল ঈশান সাদাত, পরিচালক এ মুনিম চৌধুরী ও পরিচালক জামিল আহমেদ চৌধুরী। তাদের প্রত্যেককে এক কোটি টাকা করে মোট সাত কোটি টাকা জরিমানা ধার্য করে হয়েছে।
বিএসইসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সিকিউরিটিজ বিধি-বিধান লঙ্ঘন করা করার দায়ে বানকো সিকিউরিটিজের প্রত্যেক পরিচালককে এক কোটি টাকা করে জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই অর্থদণ্ড পরিশোধে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠানটির প্রত্যেক পরিচালককে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা করে আরও জরিমানা দিতে হবে। এছাড়া আদালতে চলমান উল্লিখিত মামলার অগ্রগতি জানতে দুদকে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
তবে ব্রোকারেজ হাউজটির সমন্বিত গ্রহক হিসেবে (সিসিএ) ৬৬ কোটি ৫৯ লাখ ১৯ হাজার ১৩৩ টাকা ঘাটতির বিষয়টি নিয়ে দুদক কর্তৃক আদালতে দায়েরকৃত মামলা চলমান থাকায় বিষয়টি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
তথ্য মতে, অর্থ ও শেয়ার আত্মসাতের ঘটনা কেন্দ্র করে বানকো সিকিউরিটিজ ও এর ৭ পরিচালকের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ১৪ মে রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর মতিঝিল থানায় অভিযোগ দায়ের
করে ডিএসই। ডিএসই প্রতারণামূলক বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইনের ৪০৬ ও ৪০৯ ধারায় অভিযোগ এনেছে। পরের দিন মঙ্গলবার (১৫ জুন) সকালে মতিঝিল থানা অভিযোগটি দুদকে পাঠায়।
ডিএসইর পক্ষে দায়ের করা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালের ৬ মে ও ৬ জুন বানকো সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে শেয়ারের লেনদেন নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হয়। পরে গত ৭ জুন কোম্পানিটিতে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করে ডিএসই। ওই সময় ব্রোকারেজ হাউজটির সম্মিলিত গ্রাহক অ্যাকাউন্টে গত ৬ জুনের হিসাবে ৬৬ কোটি ৫৯ লাখ ১৯ হাজার ১৩৩ টাকার ঘাটতি পায় ডিএসই। ফলে তাৎক্ষণিক ডিএসই কোম্পানির কাছ থেকে ওই সম্মিলিত গ্রাহক অ্যাকাউন্টের ঘাটতির ‘গ্রাহকের পরিশোধযোগ্য সমন্বয়সাধন বিবরণ’ গ্রহণ করে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, বানকো সিকিউরিটিজ ও তাদের মালিকপক্ষ বিনিয়োগকারীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ ও শেয়ার আত্মসাৎ করেছে। আর এ অর্থ সমন্বয় না করেই তাদের দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কোম্পানিটির এমন কর্মকাণ্ড পুঁজিবাজারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছে। পাশাপাশি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত করে তুলেছে।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস ভঙ্গ করে তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে বানকো সিকিউরিটিজের পরিচালক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অপরাধ করেছেন। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ও পুঁজিবাজারের শৃঙ্খলার রক্ষায় ডিএসই বানকো সিকিউরিটিজসহ কোম্পানিটির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৬ ও ৪০৯ ধারায় প্রতারণামূলক বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অপরাধ করার অভিযোগ আনা হয়।
এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বানকোর চেয়ারম্যান আবদুল মুহিতকে ২৯ জুলাই হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশ আটক করে। পরে ৩০ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক আতিকুল আলম আসামিকে আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কে এম ইমরুল কায়েশের আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে ওই ঘটনা কেন্দ্র করে ডিএসইর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৫ জুলাই বানকো সিকিউরিটিজের পরিচালকদের সংশ্লিষ্ট ১০ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে সেগুলো হলোÑবানকো সিকিউরিটিজ, বানকো ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, সুব্রা সিস্টেমস, সুব্রা ফ্যাশনস, বানকো পাওয়ার, বানকো এনার্জি জেনারেশন, বানকো স্মার্ট সল্যুশন, ক্লাসিক ফুড ল্যাব, অ্যামুলেট ফার্মাসিউটিক্যালস ও সামিট প্রপার্টিজ লিমিটেড।
অর্থ আত্মসাতের ঘটনার পর দুই বছর অতিবাহিত হয়েছে এবং বানকো সিকিউরিটিজের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ইতোমধ্যে লিঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি থেকে অন্য ব্রোকারেজ হাউসে শেয়ার স্থানান্তর করে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। তবে যেসব বিনিয়োগকারীর নগদ টাকা এবং শেয়ার বিক্রির টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে তারা এখনও অনিশ্চতায় রয়েছেন।
