মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর 26, 2023

লোকসানেও শেয়ারদরে কারসাজি ৫ মাসে বেড়েছে ১০০ টাকা

ধারাবাহিকভাবে ব্যবসা পতন ও লোকসান এবং বিনিয়োগকারীরা বছরের পর বছর আশানুরূপ লভ্যাংশ না পেলেও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলেছে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ট্যানারি খাতের কোম্পানি লিগ্যাসি ফুটওয়ারের শেয়ারদর। কোম্পানির ব্যবসা লোকসানে থাকলেও গত ছয় মাসে শেয়ারটির দর কারসাজির মাধ্যমে ১৪০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। এতে গত দুই বছরের মধ্যে শেয়ারটির দর সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। অথচ এর আগে একাধিকবার শেয়ারটিতে কারসাজির কারণে জরিমানা করা হয়েছে। সেই পুরোনো কারসাজি চক্রের একটি অংশ আবার কারসাজি করে শেয়ারদর এ পর্যন্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধিতে কোম্পানির নতুন শেয়ার ইস্যু কেন্দ্র করে মূলত এই কারসাজি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এতে যাদের কাছে শেয়ারটি রয়েছে এবং যারা কারসাজি করছে, তারা শেয়ারদর অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে মুনাফা করবে। এ বিষয়ে কোম্পানির পর্ষদ, উদ্যোক্তা এবং কর্মকর্তারা সম্পৃক্ত রয়েছেন বলে জানা যায়। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এ বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো এবং কারসাজি বন্ধ করে বাজারকে স্বাভাবিক রাখা প্রয়োজন বলে জানান তারা।

কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০০ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি এ পর্যন্ত দুবার বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। আর গত ২২ বছরে মাত্র তিনবার নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানিটি। গত পাঁচ বছরের আর্থিক হিসাব অনুযায়ী, ধারাবাহিকভাবে ব্যবসা ও মুনাফার সঙ্গে সম্পদের পরিমাণও কমেছে। ২০১৮ সালে কোম্পানির নিট মুনাফা ছিল দ–ই কোটি ২৯ লাখ টাকা। আর ২০২২ সালে সবশেষ কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে এক কোটি ১২ লাখ টাকা। তার মানে কোম্পানিটি গত পাঁচ বছরে মুনাফা থেকে বড় লোকসানে নেমেছে। এদিকে ২০১৮ সালে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য ছিল ১৭ টাকা ৫৭ পয়সা। আর ২০২২ শেষে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য দাঁড়ায় ৯ টাকা ৮৩ পয়সায়। অন্যদিকে সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) কোম্পানিটির লোকসান হয় এক কোটি ১৭ লাখ টাকার বেশি। শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য হয়েছে ৮ টাকা ৯৩ পয়সা।

এদিকে কোম্পানির শেয়ারদর ও লেনদেন চিত্রে দেখা গেছে, কোম্পানিটির শেয়ারদর বর্তমানে দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থায় রয়েছে। গত পাঁচ মাসে কোম্পানির শেয়ারদর ৩৯ টাকা ৩০ পয়সা থেকে বেড়ে ১৪০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এতে পাঁচ মাসে একটি লোকসানি কোম্পানির শেয়ারদর ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এতে দেখা গেছে, শেয়ারদর গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সবশেষ ৩৯ টাকা ৩০ পয়সা ছিল। এর পর থেকে শেয়ারটির দর বৃদ্ধি ও কমানোর মাধ্যমে গত ২৭ জুলাই ১৪০ টাকা পর্যন্ত ওঠানো হয়। ৩০ জুলাই লেনদেন শেষে শেয়ারদর ছিল ১৩০ টাকা।

এদিকে লেনদেন চিত্রে দেখা গেছে, শেয়ারটির লেনদেন দুই বছরের মধ্যে গত পাঁচ মাসে সবচেয়ে বেশি হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি শেয়ারটির লেনদেন হয়েছে ৩৬ হাজার ৬৩০টি এবং ১৯ মার্চ শেয়ারটির লেনদেন হয়েছে ২৪ হাজার ১৬৫টি। কারসাজি চলাকালীন শেয়ারটির লেনদেন প্রথমে ১০ এপ্রিল হয় ১৪ লাখ ২৪ হাজার ৫৫৯টি। এরপর আরও বেড়ে ২২ মে ১৬ লাখ ৫৭ হাজার ৭২৯টি শেয়ার লেনদেন হয়। পরে ধারাবাহিকভাবে শেয়ারের লেনদেন কমতে থাকে। ৩০ জুলাই শেয়ারটির মোট ৯ লাখ ৭৮ হাজার ৭৩০টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে।

এর আগে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ অভিহিত মূল্য ১০ টাকা দরে তিন কোটি অর্ডিনারি শেয়ার ছেড়ে মোট ৩০ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে বলে জানায়, যা কোম্পানির চলতি মূলধনের ঘাটতি পূরণ করবে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থায় বোনাস শেয়ার বা রাইট শেয়ার ইস্যু করে মূলধন বাড়ানোর সুযোগ না থাকায় কোম্পানিটি নতুন শেয়ার ইস্যু করে মূলধন বাড়াতে চায়, যা শেয়ার কারাসাজির অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের কাছে একাধিকবার অস্বাভাবিকভাবে কোম্পানিটির শেয়ারদর বৃদ্ধির কারণ জানতে চাওয়া হয়। তবে লিগ্যাসি জানিয়েছে, অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারদর বৃদ্ধির পেছনে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই এবং এর কারণ তাদের জানা নেই।

বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে অনেক মৌলভিত্তি কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে রয়েছে। কিন্তু দুর্বল মৌলের বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারদর প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের শেয়ার। কোম্পানিটি লোকসানে থাকার পরও এর শেয়ারদর লাফিয়ে বাড়ছে। তালিকাভুক্তির পর থেকে কোম্পানিটি ভালো লভ্যাংশ দেয়নি। ধারাবাহিকভাবে ব্যবসা কমে এখন লোকসানে রয়েছে। এর আগে এই কোম্পানির শেয়ার কারসাজিতে কয়েকজনকে জরিমানাও করা হয়েছে। কিন্তু কোম্পানিটিতে এখন কারসাজি চললেও কোনো নজর নেই বিএসইসির।

কোম্পানি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও অধিক শেয়ার থাকা শেয়ারহোল্ডাররা এই কারসাজি করছে বলে জানিয়ে তারা বলেন, এর আগে কোম্পানিটির শেয়ার কারসাজিতে কোম্পানির পর্ষদ, উদ্যোক্তা ও কর্মকর্তাদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়। সেই সঙ্গে যাদের হাতে কোম্পানির অধিক শেয়ার রয়েছে, তারা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ারহোল্ডারদের যোগসাজোশে এই কারসাজি করা হয়। কোম্পানিটি নতুন করে শেয়ার ইস্যু করবে। এতে যাদের কাছে শেয়ার থাকবে তারা শেয়ার পাবে। ফলে যাদের কাছে কোম্পানির অধিক শেয়ার আছে তারা কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে পরে বেশি দামে সেগুলো বিক্রি করবে। এতে যারা সেসময় শেয়ার কিনবে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে তারা। তাই এ বিষয়ে বিএসইসির এখনই পদক্ষেপ নেয়া উচিত। কোম্পানির কারসাজি বন্ধ করে সংশ্লিষ্টদের কঠিন শাস্তির মাধ্যমে বাজারে আস্থা ধরে রাখা জরুরি বলে জানান তারা।

এ বিষয়ে জানতে কোম্পানিটির সচিব মো. আব্দুল বাতেন ভুঁইয়াকে (চলতি দায়িত্ব)ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। এরপর তাকে ফোনে মেসেজ করা হলে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো উত্তর দেননি।

প্রসঙ্গত, লিগ্যাসি ফুটওয়্যারসহ দুই কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করায় ২০১৯ সালে চার ব্যক্তি ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে মোট পাঁচ কোটি ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি। এসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা করায় কমার্স ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডকে সতর্ক করে বিএসইসি। ব্রোকারেজ ফার্মটির তৎকালীন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসভিপি) সাইফুল ইসলাম এসব কোম্পানির শেয়ার কারসাজির ইন্ধনদাতা বলে অভিযোগ ওঠে।

তথ্য মতে, কমিশনের তদন্তে বিডি অটোকারস লিমিটেড এবং লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের শেয়ার লেনদেনে অনিয়ম পাওয়া যায়। আলোচিত কোম্পানিগুলোর শেয়ার কারসাজির সঙ্গে আবদুল কাউয়ুম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস (আবদুল কাউয়ুম, মরিয়ম নেছা ও মেসার্স কাউয়ুম অ্যান্ড সন্স), মইনুল হক খান অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস (পদ্মা প্লাস লিমিটেড, পদ্মা জোন্স অ্যান্ড কলার্ম লিমিটেড ইউনিট-২, রহমত মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড), মাহফুজ আলম, কমার্স ব্যাংক সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং মো. আজিমুল ইসলাম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস (মো. আজিমুল ইসলাম, লতফুন নেছা ইসলাম, নাবিলা ইসলাম, আজিজুল ইসলাম, আলিফ টেক্সটাইল মিলস, বায়তুল খামুর) জড়িত ছিলেন।

এ ধরনের কাজ সিকিউরিটিজ আইনের লঙ্ঘন। আর আইন ভঙ্গ করে শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে কমিশন আবদুল কাউয়ুম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে দুই কোটি, মইনুল হক খান অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে ১০ লাখ, মাহফুজ আলমকে এক কোটি এবং মো. আজিমুল ইসলাম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে দুই কোটি টাকা জরিমানা করেছে। একই সঙ্গে কমার্স ব্যাংক সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টকে সতর্কপত্র ইস্যু করবে কমিশন।

spot_img

অন্যান্য সংবাদ