ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়লেও খেলাপি ঋণ থেকে অর্থ আদায়ের অবস্থা নাজুক। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ থেকে অর্থ আদায়ের পরিমাণ কমেছে ১ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা বা ৩৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর উদাসীনতা রয়েছে। তাছাড়া অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ আদায় হচ্ছে না। এর জন্য খেলাপি ঋণ আদায়ে নাজুক অবস্থা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) সময়ে বাণিজ্যক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ থেকে আদায় হয়েছে ৩ হাজার ৩১৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা; আগের প্রান্তিকে (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) আদায়ের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ২৭৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আদায় কমেছে ১ হাজার ৯৬৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা বা ৩৭ দশমিক ২১ শতাংশ। গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ থেকে আদায় হয়েছে ১ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। আগের প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) আদায় হয়েছিল ৩ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা।
যে গতিতে ব্যাংক খাতের খেলাপি বাড়ছে। সেই গতিতে খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) সময়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। যেখানে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। সেখানে একই সময় খেলাপি ঋণ থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা।
গত ৩১ মার্চ দেশে ব্যাংক খাতে ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশই এখন খেলাপি। ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।
কয়েকজন ব্যাংকার বলছেন, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের যে তথ্য দিয়েছিল, তা নিরীক্ষিত ছিল না। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিদর্শনে কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ খেলাপি করে দেয়া হয়। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর অনেক ঋণ নতুন করে খেলাপি হয়েছে। বেসরকারি খাতের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিকেই উদ্বেগজনক মনে করছেন তারা।
তিন মাসের ব্যবধানে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। অথচ এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ডিসেম্বর শেষে ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, খেলাপি ঋণ যে হারে বাড়ছে, সে তুলনায় আদায় কম হওয়ার কারণ হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে শিথিল নীতি। ফলে দেখা যাচ্ছে, খেলাপি বাড়ছে, আদায় কম হচ্ছে। যেসব ব্যবসায়ী প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের জন্য সার্কুলার ঠিক আছে। অপরদিকে কিছু ব্যবসায়ী এটার সুযোগ নিয়ে টাকা পরিশোধ করছেন না। এতে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকে টাকা আসছে না এবং ব্যাংক নতুন করে ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংক।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব শিথিলতা দিয়েছে, তা ক্রমেই কমিয়ে আনা উচিত। ঋণ আদায়ে কঠোর বার্তা দেয়া উচিত। এছাড়া বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি বা অন্য উপায়ে আদায়ের ওপর জোর দিতে হবে। আর ব্যবসায়ীদের স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে ঋণ পরিশোধ করার মানসিকতা থাকা উচিত।
কভিডের সংক্রমণ শুরুর পর ২০২০ সালে ঋণ পরিশোধে অনেক ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই বছর ঢালাওভাবে ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ দেয়া হয়। ২০২১ সালে যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা ছিল, তার মাত্র ১৫ শতাংশ দিলেই তাদের নিয়মিত দেখানো হয়। এরপর ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে একজনের যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা ছিল, তার মাত্র ৫০ শতাংশ দিলেই তাকে আর খেলাপি করা হয়নি। এর মধ্যে গত বছরের জুলাইয়ে ঋণ পুনঃতফশিল নীতিমালা ব্যাপক শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে ডাউনপেমেন্ট, মেয়াদসহ বিভিন্ন বিষয় শিথিল করা হয়। চলতি বছরও নতুন করে ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২০ জুন জারি করা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, আগামী জুনের মধ্যে ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিলে কোনো খাতককে আর খেলাপি করা যাবে না। ফলে যারা ঋণ নিয়ে কিস্তি শোধ না করে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছিলেন, তারা এখন কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিয়েই নিয়মিত গ্রাহক থাকতে পারবেন। মেয়াদি ও তলবি ঋণের ক্ষেত্রে এই সুবিধা মিলবে।