শুক্রবার, জুন 2, 2023

ওষুধ খাতে সুবাতাসঃ আয় বাড়ছে অধিকাংশ কোম্পানির

পুঁজিবাজারে ওষুধ ও রসায়ন খাতে তালিকাভুক্ত দেশের বেশির ভাগ কোম্পানির তৃতীয় প্রান্তিকে আয় বেড়েছে। মহামারীর প্রভাব কাটিয়ে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি মুনাফা করেছে এসব কোম্পানি। স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, এই খাতে সরকারের নানা পদক্ষেপ আর ব্যাংকের সুলভে অর্থায়নই মুনাফা বৃদ্ধির মূল কারন বলে মনে করছেন এই খাত সংশ্লিষ্টরা।

বিক্রির হিসেবে দেশের শীর্ষ ১০টি ওষুধ কোম্পানির প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় প্রত্যেকেই তিন প্রান্তিকে আগের চেয়ে বেশি মুনাফা করেছে। ৯ মাস শেষে এই ১০ কোম্পানি মোট ২ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকার বেশি আয় করেছে। আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৩৭৬ কোটি টাকা মুনাফা বেড়েছে কোম্পানিগুলোর। এ হিসেবে মুনাফায় গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশেরও বেশি। আর এতে বেশ আশাবাদি হয়েছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রবৃদ্ধিকে বেশ উৎসাহব্যঞ্জক বলে মন্তব্য করেন অন্যতম শীর্ষ ওষুধ প্রস্তুতকারক এসিআই লিমিটেডের কোম্পানি সচিব মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, করোনা মহামারির সময়ে এ খাত কিছুটা ধীরগতি দেখেছিল। তখন মানুষ খুব জরুরী প্রয়োজন না হলে চিকিৎসকের কাছে যেত না। আবার অনেক চিকিৎসকও জরুরী প্রয়োজন ছাড়া রোগি দেখতেন না। এ অবস্থা এখন অনেকটাই কেটে গেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কারনে বিক্রি বাড়ায় এবার সবাই মোটামুটি ভালো মুনাফা করেছে।

একই সাথে সাধারণ জনগনের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিকেও বিক্রি বাড়ার অন্যতম কারন বলে মনে করেন অন্য ওষুধ প্রস্তুতকারক বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আসাদ উল্লাহ। তাদেরই একটি সহযোগি প্রতিষ্ঠান নুভিস্তা ফার্মাসিউটিক্যালস তৈরী করে হরমোন ও ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট। তিনি জানান, করোনা মহামারি আমাদের সবাইকেই স্বাস্থ্য সচেতন করেছে। এ কারনে ভিটামিন ও সাপ্লিমেন্টারি ওষুধের চাহিদা বেড়েছে। এছাড়াও এখন অনেকেই রোগ জটিল পরিস্থিতে যাওয়ার আগেই চিকিৎসা শুরু করতে চান। সব মিলিয়ে তাই বিক্রি বেড়েছে ওষুধ কোম্পানিগুলোর।

স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কোম্পানিগুলোতে সুলভে ব্যাংক অর্থায়ন ও সরকারের নানা প্রনোদনাও আয় বৃদ্ধিতে ভুমিকা রেখেছে বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এই বক্তব্যের সাথে সুর মেলান দেশের শীর্ষ ওষুধ প্রস্তুতকারক স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের কোম্পানি সচিব খন্দকার হাবিব-উজ-জামানও। কেনিয়ায় উৎপাদনের মাধ্যমে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ওষুধ রফতানি শুরু করতে যাওয়া কোম্পানিটির সচিব জানান, সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপে এ খাতে এখন সুবাতাস বইছে। রপ্তানিতে কর প্রনোদনা দেয়ায় এবং ব্যাংকের সুদের হার কমায় কোম্পানিগুলো আরও ভালো করার সুযোগ পাচ্ছে।

দেশের শীর্ষ ওষুধ কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২১-২২ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে সবচে বেশি মুনাফাও করেছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। এবার তাদের মুনাফা হয়েছে প্রায় ১২৭৫ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ের চাইতে ১৯৫ কোটি টাকারও বেশি। সে হিসেবে তাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ শতাংশের মত।
এ মুনাফার পেছনের পরিচালনা দক্ষতার পাশাপাশি ডলারের দাম বাড়াও একটি বড় কারন বলে মনে করছে কোম্পানিটি। কোম্পানিটি এই ৯ মাসে ১২৪ কোটি টাকার বেশি ওষুধ রপ্তানি করেছে। এছাড়াও ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন করে রপ্তানির কারনে কর অবকাশ সুবিধা কোম্পানির আয় বাড়াতে সহায়ক হয়েছে।

মুনাফার হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। এই ৯ মাসে কোম্পানিটি এবার ৪২০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে। যা গত বছরের একই সময়ের চাইতে ৫০ কোটি টাকারও বেশি। সে হিসেবে কোম্পানিটির মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩.৭ শতাংশ। সরকারের কাছে করোনার টিকা বিক্রি করে কোম্পানিটি প্রায় ৬২ কোটি টাকা আয় করেছে। এছাড়াও কোম্পানিটি গত বছর অক্টোবরে ৫৪ দশমিক ৬ শতাংশ শেয়ার কিনে সানোফি বাংলাদেশ লিমিটেডকে অধিগ্রহন করে। অধিগ্রহনের পরপরই কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে সাইনোভিয়া ফার্মা পিএলসি করা হয়। বছর শেষে বেক্সিমকোর আয়ের একটি অংশ এ কোম্পানি থেকেও আসবে।
এ সম্পর্কে বেক্সিমকো ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান বলেন, সানোফি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশীদারত্ব অধিগ্রহণের পর থেকে আমরা এর ক্রেতা ও পণ্যগুলো একীভূতকরণে গুরুত্ব দিই। আশা করি সানোফির নতুন এবং যুগান্তকারী থেরাপিগুলো আগামীতে সাশ্রয়ী মূল্যে বাংলাদেশে বাজারজাত করার মাধ্যমে সাইনোভিয়া বেক্সিমকো ফার্মার ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

ওষুধ খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে এই তিন প্রান্তিকে সবচে বেশি শেয়ার প্রতি আয় করেছে রেনাটা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। ৯ মাসে কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি ৩৮ টাকা ৩৮ পয়সা আয় করেছে। মুনাফায় তৃতীয় অবস্থানে থাকা রেনেটা ২১-২২ অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে ২ হাজার ২৬৪ কোটি টাকার পন্য বিক্রি করেছে। আর কর পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ৪০৫ কোটি টাকার বেশি। গতবছরের একই সময়ের চাইতে যা প্রায় ১১ শতাংশ বা ৩৯ কোটি টাকা বেশি।
ওষুধ শিল্পের জন্য প্রবৃদ্ধির এ হার স্বাভাবিক বলে মনে করেন রেনাটার কোম্পানি সচিব জুবায়ের আলম। তিনি বলেন, এই খাতে বার্ষিক ১০-১১ শতাংশ করে প্রবৃদ্ধি হয়ে থাকে। করোনার পরে কিছুটা ধীরে চললেও আবার সব স্বাভাবিক হওয়ায় সবারই মুনাফা বাড়ছে। তবে খরচ কমানো কিংবা কোভিড-সম্পর্কিত ওষুধ বিক্রির কারনে কিছু কোম্পানির বিক্রি বেড়ে থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

চতুর্থ অবস্থানে থাকা একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের মুনাফায় বেশ বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের চাইতে ৩৫ শতাংশ আয় বেড়েছে একমির। কোম্পানিটি শেষ ৯ মাসে আয় করেছে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চাইতে সাড়ে ৪১ কোটি টাকা বেশি। কোম্পনিটির বিক্রি বাড়ার পাশাপাশি পরিচালন ব্যয় কম হওয়ায় মুনাফায় এ প্রবৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে বলে জানান কোম্পানি সচিব আরশাদুল কবির।

ক্যান্সারের ওষুধের রফতানি করা বাংলাদেশের প্রথম ওষুধ প্রস্ততকারক বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড মুনাফার তালিকায় পঞ্চম অবস্থানের রয়েছে। কোম্পানিটি এবার ৮২ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে যা আগের বছরের একই সময়ের চাইতে ৯ শতাংশ বা ৭ কোটি টাকা বেশি।

শীর্ষ ১০টি কোম্পানির অন্যগুলোর মধ্যে ওরিয়ন ফার্মা লিমিটেড প্রায় ৭২ কোটি টাকা, এসিআই লিমিটেড ৪৩ কোটি টাকা, দি ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড সাড়ে ৪১ কোটি টাকা, এসিআই ফর্মুলেশন লিমিটেড ২৫ কোটি টাকা, কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানী লিমিটেড সাড়ে ২৩ কোটি টাকারও বেশি মুনাফা অর্জন করেছে।

spot_img

অন্যান্য সংবাদ