চলতি বছরের মধ্যেই দেশে পণ্য কেনাবেচার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু করতে চায় চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)। আর তাতে সায় দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। দেশের পুঁজিবাজারে পণ্য-সেবায় বৈচিত্র্য আনতেই এই উদ্যোগ। শুরুতে গম, তুলা ও সোনা কেনাবেচার মাধ্যমে দেশের প্রথম পণ্য বিপণনের এই এক্সচেঞ্জটি চালু করবে সিএসই।
বহু আকাংখিত কমোডিটি মার্কেটকে ঘিরে তাই আশা বাধছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, কমোডিটি মার্কেট চালু হলে উৎপাদক ও ভোক্তারা সঠিক দামে পন্য কেনা-বেচা করতে পারবেন। অন্য দিকে মধ্যস্বত্বভোগিরা দাম নিয়ে কোন কারসাজি করার সুযোগ হারাবে। এতে বাজারে খানিকটা হলেও স্বস্তি ফেরত আসবে।
বাংলাদেশে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর জন্য এরই মধ্যে ভারতের মুম্বাইভিত্তিক কমোডিটি এক্সচেঞ্জ এমসিএক্সকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান সম্ভাব্যতা যাচাই করবে। একই সঙ্গে প্রাথমিকভাবে কোন কোন পণ্য নিয়ে এ এক্সচেঞ্জ চালু করা যায়, তার গাইডলাইন দেবে প্রতিষ্ঠানটি।
কমোডিটি এক্সচেঞ্জ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা যেখানে এত দূর এগিয়ে গেছেন, সেখানে দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারিরা রয়েছেন কিছুটা অন্ধকারের মধ্যেই। দেশে কমোডিটি এক্সচেঞ্জের এই ধারণাটি নতুন হওয়ায় অনেকের মনেই রয়েছে বিভিন্ন প্রশ্ন। আমাদের অনেক পাঠকই ফোনে, ফেসবুকে আমাদের কাছে জানতে চেয়েছেন এর বিস্তারিত। তাদের কথা মাথায় রেখেই কমোডিটি মার্কেটের আদ্যপান্ত নিয়ে আজকের লেখা। লিখেছেন শাফিউন ইবনে শাহীন।
কমোডিটি এক্সচেঞ্জ কী?
কমোডিটি মানে নিত্য ভোগ্যপণ্য। ভোগ্যপণ্য যেখানে কেনাবেচা হয়, সেটি কমোডিটি মার্কেট বা ভোগ্যপণ্যের বাজার। আর ভোগ্যপণ্য শেয়াবাজারের মতো কোনো প্ল্যাটফর্মে বেচাকেনা হলে তাকে বলে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) এখন যেমন স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে শেয়ার বা ঋণপত্র কেনাবেচা হয়, তেমনই একটি এক্সচেঞ্জে কেনাবেচা হবে সোনা-রুপা, তেল-ডাল, আলু-পিয়াজ, ধান-চাল ও পাটের মতো পণ্য।
অবশ্য কমোডিটি এক্সচেঞ্জে ক্রেতা ও বিক্রেতার সরাসরি পণ্য কেনাবেচার সুযোগ নেই। অনেকটা শেয়ারের মতো বিক্রেতার দেওয়া পণ্যের সার্টিফিকেট (মান সনদসহ) বিক্রি হয়। মান সনদ দেখেই পণ্যের গুণগত মান বিষয়ে নিশ্চিত হন ক্রেতা। শুধু দেশে থেকেই নয়, অন্য দেশে থেকেও কেনাবেচা করা যায় এই এক্সচেঞ্জে। এই কেনাবেচা হয় ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে। এতে মূল পণ্যটি থাকে কোনো গুদামে বা মাঠে। সেখান থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর এটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি বা হস্তান্তর হয়।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, কমোডিটি এক্সচেঞ্জে কিছু গম কেনা-বেচা হবে। সরাসরি কৃষক বা গুদাম মালিক, যার মালিকানায় পণ্যটি রয়েছে তিনিই এই গম বিক্রি করতে পারবেন। আর কমোডিটি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে যে কেউ এই গম কিনতে পারবেন। আইনের মাধ্যমে এই গম কেনাবেচার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য নির্ধারিত একটি সময় বেঁধে দেওয়া হবে। ওই সময় ক্রয় আদেশটি যার হাতে থাকবে, তাঁকে বিক্রীত ওই গম বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
এই ধরনটি অনেকটা কারখানার মিলগেটে ডেলিভারি অর্ডার বা ডিও কেনাবেচার মতো। মধ্যে অনেকবার কেনা-বেচা হলেও সময়ের শেষে যার কাছে সনদ থাকবে সেই হবে পণ্যের মালিক।
কেনাবেচার প্রক্রিয়া কী?
শেয়ারবাজারের মতো কমোডিটি এক্সচেঞ্জেও নির্দিষ্ট ও অনুমোদিত ব্রোকারের মাধ্যমে পণ্য কেনাবেচা করতে হয়। থাকতে হয় নিজ বা প্রতিষ্ঠানের নামে অ্যাকাউন্ট। এ বাজারে পণ্য কিনে তা ডেলিভারি না নিয়ে ক্রয়কৃত সার্টিফিকেট অন্য কারও কাছে বিক্রিও করা যায়।
এখানে কেনাবেচার প্রাথমিক প্রক্রিয়া কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচার মতোই। ব্রোকারের মাধ্যমে বিক্রেতা পণ্য বিক্রির আদেশ দেন। অন্যদিকে ক্রেতা তার ব্রোকারের মাধ্যমে ক্রয় আদেশ দেন। বর্তমানের অনলাইন ব্যবস্থায় উভয়ের কেনাবেচার অর্ডার প্রদর্শিত হয় কমোডিটি এক্সচেঞ্জের ইলেকট্রনিক বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। ক্রেতা-বিক্রেতার দর মিললে লেনদেন হয়। তবে লেনদেন নিষ্পত্তি হয় ক্লিয়ারিং অ্যান্ড সেটেলমেন্ট হাউসের মাধ্যমে। প্রথমে ক্যাশ সেটেলমেন্ট অর্থাৎ ক্রেতার ব্রোকার থেকে অর্থ নিয়ে বিক্রেতার ব্রোকার অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। এরপর চুক্তি অনুযায়ী ফিজিক্যাল ডেলিভারি সম্পন্ন করতে পণ্যটি যে ওয়্যারহাউস বা কোল্ডস্টোরেজে রয়েছে, ক্রেতার অর্ডার অনুযায়ী ওই পণ্য পরিবহনে পৌছে দেয়া হয়।
আবার পণ্য বিদ্যমান না থাকার পরও ওই পণ্য কেনাবেচা করা যায় কমোডিটি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে। কমোডিটি এক্সচেঞ্জের বাজারের এ অংশকে ‘ফিউচার কন্ট্রাক্ট’ বলা হয়। যেমন মৌসুমি ফল আম বা এ ধরনের পণ্য সাধারণত সারা বছর হয় না। চাইলে কোনো বিক্রেতা এ ধরনের ফসল আগাম বিক্রির আদেশ দিতে পারেন। ওই আদেশ অনুযায়ী, কোনো ক্রেতা তা আগাম কিনেও নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পণ্য এক মাস বা দুই মাস বা তারও বেশি সময় পর ডেলিভারি হতে পারে। শুধু মৌসুমি নয়, যে কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের ফিউচার কন্ট্রাক্ট হতে পারে।
কমোডিটি এক্সচেঞ্জ কেন দরকার?
বৃহৎ বাজার বিবেচনায় বাংলাদেশে একটি কমোডিটি এক্সচেঞ্জের সম্ভাবনা ব্যাপক। বাংলাদেশ যেমন অনেক পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করে, আবার অনেক পণ্য রপ্তানিও করে। এসব আমদানি-রপ্তানির প্রায় পুরোটা ক্রেতা ও বিক্রেতার সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। কমোডিটি এক্সচেঞ্জ হলে বিশ্বের আগ্রহী সব ক্রেতা-বিক্রেতাকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়ে পণ্য কেনাবেচার সুযোগ করে দেবে। এতে পণ্যমূল্যে ভারসাম্য নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ বাড়বে। ফড়িয়াদের কারসাজিতে কিংবা সিন্ডিকেটের কারনে কম দামে পন্য বিক্রি করার ঝুকি অনেকটাই হ্রাস পাবে। বাংলাদেশের বাজারে সিন্ডিকেটভিত্তিক পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে দিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
পণ্যের দাম আগে থেকেই জানতে পারায় কৃষকের খরচ ওঠা নিয়েও দুশ্চিন্তা করতে হয় না। কোন মৌসুমে কোন ফসল চাষ করলে বেশি লাভ হতে পারে সেটা কৃষক আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এছাড়াও কমোডিটি বাজারের কারণে কোনো এলাকার অতিরিক্ত উৎপাদন হলে পন্য চাহিদা মতো ঘাটতি এলাকায় যেতে পারে।
এ ধরনের বাজারে যেহেতু ক্রেতা-বিক্রেতার সরাসরি পণ্য দেখে বা দেখিয়ে কেনাবেচার সুযোগ নেই, তাই কমোডিটি এক্সচেঞ্জই পণ্যের গুণগতমান নিশ্চিতের নানা ব্যবস্থা করে থাকে। শক্ত নজরদারির কারনে কমোডিটি এক্সচেঞ্জে মানহীন পন্যের কেনা-বেচা কঠিন হয়ে পড়ে। ভোক্তাপর্যায়ে সঠিক মানের পন্য সঠিক দামে মেলে। এতে বাজারে খানিকটা হলেও স্বস্তি ফেরত আসবে।
এছাড়াও কমোডিটি এক্সচেঞ্জের কারনে নতুন নতুন বিনিয়োগ সম্ভাবনা বাড়ে। ফসল তোলা পরবর্তী অবকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজন হয়। মান নিশ্চিত করার স্বার্থে উপযুক্ত মানের ওয়্যারহাউস ও কোল্ডস্টোরেজ স্থাপন করতে হয়। কৃষককে তখন আর পন্য মজুদের মতো সমস্যায় ভুগতে হয় না। পন্য নষ্ট হওয়ার মতো সমস্যা না থাকায় বাজারে সংকট তৈরী হওয়ার সম্ভাবনাও বহুলাংশে কমে যায়।
এ তো গেলো শুধু কৃষক ও ভোক্তা পর্যায়ের সুবিধার কথা। এর বাইরেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনে কমোডিটি মার্কেট। স্টক-বন্ড ও মিউচুয়াল ফান্ডের বাইরেও বিনিয়োগের সুযোগ এনে দেয় কমোডিটি ডেরিভেটিভস।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনার পাশাপাশি বিনিয়োগে ঝুঁকি কমায় কমোডিটি ডেরিভেটিভস। বাজারে কখনো ধস হলেও বিনিয়োগকারীদের লোকসান তখন তত বেশি হয় না। যেহেতু শুধু বায়নাপত্রই কেনা-বেচা হয় তাই অল্প বিনিয়োগ করেও এখান থেকে বেশি রিটার্ন পাওয়া যায়।
স্টক মার্কেটের সাথে কমোডিটি মার্কেটের পার্থক্য কি?
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) এখন যেমন স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে শেয়ার বা ঋণপত্র কেনাবেচা হয়, তেমনই এই এক্সচেঞ্জে কেনাবেচা হবে বিভিন্ন পন্যের। শেয়ারবাজারের সাথে লেনদেন ও ধরনের বেশ কিছু মিল যেমন আছে, তেমনি মোটাদাগে পার্থক্যও রয়েছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে। চলুন দেখে নেয়া যাক স্টক মার্কেটের সাথে এই এক্সচেঞ্জের কী কী পার্থক্য আছে।
আলাদা এক্সচেঞ্জ, আলাদা নিয়ম
কমোডিটি ট্রেডিংয়ের জন্য আলাদা এক্সচেঞ্জ হবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) বাইরে এই কমোডিটি এক্সচেঞ্জটি পরিচালিত হবে। এর জন্য আলাদা বিধি ও আইন নির্ধারণ করা হবে।
সাধারণ বিও একাউন্ট দিয়ে এই মার্কেটে ট্রেড করা যাবে না। এর জন্য আলাদা ট্রেডিং একাউন্ট খুলতে হবে। এর জন্য আলাদা ব্রোকারও থাকবে।
ট্রেডিংয়ের সময়েও থাকবে পার্থক্য। স্টক মার্কেট বেলা আড়াইটায় বন্ধ হয়ে গেলেও বিশ্ববাজারের সাথে মিল রেখে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলবে কমোডিটি মার্কেট।
পন্য নয়, বিক্রি হয় চুক্তিপত্র
স্টক মার্কেটে যেমন কোম্পানির শেয়ার কেনা-বেচার সাথে সাথে তা একাউন্টে ট্রান্সফার হয়ে যায় এখানে তেমনটি হবে না। পন্য কৃষকের কাছে কিংবা গুদামেই থাকবে। সেখান থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর এটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি বা হস্তান্তর হবে। এখানে মূলত কেনা-বেচা হবে চুক্তিপত্রের। একে ফিউচার কন্ট্রাক্ট (Future Contract)বলা হয়ে থাকে।
আইনের মাধ্যমে এই চুক্তিপত্রের চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য নির্দিষ্ট একটি সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে বাজারের চাহিদা বুঝে যে কেউ তার কাছে থাকা এই চুক্তিপত্র ইচ্ছে মত দামে বিক্রি করতে পারবে। এরপর নির্ধারিত সময়ে ক্রয় আদেশটি যার হাতে থাকবে, তাঁকে বিক্রিত পন্য বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে
কমোডিটি মার্কেটের ফিউচার কন্ট্রাক্ট একটি নির্দিষ্ট সময়ে তার মেয়াদ হারায়। তাই একে স্টক মার্কেটের শেয়ারের মত যতদিন ইচ্ছে হাতে ধরে রাখা যায় না।
এটি যেহেতু নির্ধারিত সময়ের চুক্তিপত্রের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় তাই সময় শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাজারে চলতি দরে একাউন্টে টাকা জমা হবে।
লাভ তুলে আনতে সময় বেশি লাগে
স্টক মার্কেটে স্বল্প সময়ের জন্য বিনিয়োগ করা যায়। কেউ চাইলেই প্রথমদিন শেয়ার কিনে তৃতীয় দিন ভালো দামে শেয়ার বিক্রি করে বের হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু কমোডিটি মার্কেটের বিনিয়োগ কিছুটা দীর্ঘ সময়ের জন্য হয়ে থাকে। বিশ্ববাজারে খুব বড় কোন হেরফের না হলে বিনিয়োগ করে মুনাফা তুলে আনতে সপ্তাহ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
অস্থিরতা কম, কারসাজি কম
স্টক মার্কেটে কোম্পানির শেয়ার নির্দিষ্ট হওয়ায় খুব সহজেই কৃত্তিম ভাবে চাহিদা ও যোগান নিয়ন্ত্রন করা যায়। তাই স্টক মার্কেটে শেয়ারের দরে অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়। কখনো শেয়ারের দাম কেন বাড়লো বা কেন কমলো অনেক সাধারণ বিনিয়োগকারিরা বুঝতেই পারেন না।
সেদিক থেকে কমোডিটি মার্কেটে বিনিয়োগ করে অনেকটাই নিশ্চিন্ত থাকা যায়। কমোডিটি মার্কেটের সব পন্যের দাম নির্ধারণ হয়ে সাধারন বাজারে ভোক্তার চাহিদার উপর নির্ভর করে। এছাড়াও কমোডটি মার্কেটের পন্য বিশ্বের সব বাজারের সাথে সংযুক্ত থাকায় কেউ চাইলেও এর দর নিয়ে কারসাজি করতে পারে না। এর নজরদারি অনেক বেশি শক্ত হওয়ায় বিনিয়োগকারির পুঁজি তুলনামূলক নিরাপদ থাকে।
মুনাফা যেমন বেশি, ক্ষতির ঝুকিও তেমন বেশি
তবে এর বিপরীত চিত্রও আছে। স্টক মার্কেটে কোন শেয়ারের দর ওঠা-নামার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ১০ শতাংশের সার্কিট ব্রেকার দিয়ে রাখতে পারে। তবে কমোডিটি মার্কেটে এমন কোন ব্যবস্থা নেই। মুনাফা যেমন এখানে অনেক বেশি, তেমনি প্রাকৃতিক কারনে বা বৈশ্বিক পরিস্থিতে ক্ষতির পরিমান দ্বিগুন-তিনগুনও হয়ে যেতে পারে।
লভ্যাংশ পাওয়া যায় না
সাধারণ স্টক মার্কেটে শেয়ার কিনলে শুধু শেয়ার বিক্রি করেই লাভ করা যায় না, সাথে শেয়ারের লভ্যাংশও পাওয়া যায় বছর শেষে। তবে কমোডিটি মার্কেটে এমন কোন সুযোগ নেই।
লটে কেনা-বেচা
লটের সাইজেও পার্থক্য আছে স্টক মার্কেটের সাথে কমোডটি মার্কেটের। স্টক মার্কেটে কেউ চাইলে একটি শেয়ার কিনেও কোন কোম্পানির বিনিয়োগকারি হতে পারেন। কিন্তু কমোডটি মার্কেটে কেনা-বেচা করতে চাইলে তাকে অবশ্যই লটে কেনা-বেচা করতে হবে। লটেও আবার বৈচিত্র আছে। যেমন সোনার কেনাবেচা হয় গ্রামের (gm) লটে, আবার গম কেনাবেচা হয় কুইন্টাল বা টন হিসেবে।
সর্বনিম্ম বিনিয়োগ
একটি বিও একাউন্ট ও তাতে সর্বনিম্ম ১০ টাকা হলেই স্টক মার্কেটে যে কেউ লেনদেন করতে পারে। তবে কমোডিটি মার্কেটে আপনার এরচে বেশি টাকা থাকতে হবে। এমনকি এই মার্কেটে লেনদেন করতে হলে আপনার আলাদা করে দুইবার বিনিয়োগ করতে হবে। প্রথমে একাউন্ট খোলার সময় প্রাথমিক বায়না-পত্রের জন্য টাকা দেয়া লাগবে।। এরপর আবার যখন কমোডিটি মার্কেটের কিছু কিনবেন তখন আবার পন্যের অনুপাতে টাকা জমা করতে হবে।
কারা আনছে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ?
দেশে প্রথমবারের মত ‘কমোডিটি এক্সচেঞ্জ’ বা ‘ফিউচার্স মার্কেট’ চালু করতে ভারতের মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জের (এমসিএক্স) সঙ্গে জোট বাঁধতে যাচ্ছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)। এক্সচেঞ্জ চালুর জন্য ভারতের মুম্বাইভিত্তিক কমোডিটি এক্সচেঞ্জ এমসিএক্সকে মুলত পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান সম্ভাব্যতা যাচাই করবে। একই সঙ্গে প্রাথমিকভাবে কোন কোন পণ্য নিয়ে এ এক্সচেঞ্জ চালু করা যায়, তার গাইডলাইনও দেবে। তবে কমোডিটি এক্সচেঞ্জটি শতভাগ সিএসইর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় চলবে। যেখানে এমসিএক্স পরামর্শক হিসেবে শুধু পাঁচ বছরের জন্য কাজ করবে।
চলতি বছরের মার্চের শুরুতে প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে পরামর্শ চুক্তির বিষয়টি জানিয়ে বিএসইসিকে একটি চিঠি পাঠায় সিএসই। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য এমসিএক্সের কাছ থেকে চুক্তি অনুযায়ী পরামর্শভিত্তিক পরিষেবাগুলো নিতে সম্মতি দেয় বিএসইসি।
তবে বাংলাদেশের আইন মেনে এ পরিষেবা গ্রহণ করতে হবে সিএসইকে। সিইসি যেই নিয়ম পদ্ধতিগুলো ঠিক করবে, সেগুলো বিএসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বিভিন্ন সরকারি এজেন্সির সঙ্গে বসেই ঠিক করা হবে।
স্টক এক্সচেঞ্জের কার্যক্রম পরিচালনার তুলনায় কমোডিটি এক্সচেঞ্জ পরিচালনা বেশ জটিল বলে দাবি করছে সিএসই। তাদের মতে, স্টক এক্সচেঞ্জে এখন শুধু ডিমেটেড শেয়ার বা ইলেকট্রনিক শেয়ার কেনাবেচা হয়। ইলেট্রনিক শেয়ারগুলোর কাস্টডিয়ান হিসেবে সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি প্রতিষ্ঠান সিডিবিএল কাজ করছে। ইলেকট্রনিক ব্যবস্থায় এখন শেয়ার জাল হওয়ার সুযোগ নেই। ফলে শেয়ারের লেনদেন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলেই স্টক এক্সচেঞ্জের কাজ অনেকটা সম্পন্ন হয়। কিন্তু কমোডিটি এক্সচেঞ্জের ক্ষেত্রে পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় হলে বড় সমস্যা হতে পারে। তা ছাড়া পণ্য ডেলিভারি ব্যবস্থার দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। বাজার ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন করতে গিয়ে যাতে কোনো দুর্ঘটনা না হয়, সেটি নিশ্চিত করেই কমোডিটি এক্সচেঞ্জ করা হবে বলে জানিয়েছে সিএসই।
সিএসই বলছে, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠা হলে কৃষক/ উৎপাদক থেকে শেষ ব্যবহারকারী পর্যন্ত পণ্যের মূল্য একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখা, ফসল তোলার পর ক্ষতির ঝুঁকি কমানো, দক্ষ ঋণ ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক দর নির্ধারণ ব্যবস্থা তৈরি করা এবং লেনদেন ও বিপণন ব্যয় কমিয়ে আনা সহজ হবে। তবে পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করতে হলে আরও বেশ কিছু প্রস্তুতি শেষ করতে চায় সিএসই।
উল্লেখ্য, ২০০৩ সালে কার্যক্রম শুরু করা এমসিএক্স এখন ভারতের সবচে বড় কমোডিটি এক্সচেঞ্জ। এটি ভারত সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন। ভারতের কমোডিটি মার্কেটের প্রায় ৮৮ শতাংশ লেনদেন হয় এমসিএক্সে। এই মার্কেটে প্রতিদিন গড়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকার চুক্তিপত্র কেনাবেচা হয়। এখানে মূলত অকৃষিপণ্যই বেশি বিকিকিনি হয়। ২০১৯ সালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া পাডালা সুব্বি রেড্ডি (পি এস রেড্ডি) এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান।
শুরুর শুরু কবে?
দেশে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠার জন্য ২০০৭ সালের ১৬ এপ্রিল সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর ২০০৮ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিএসইসিতে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠার আবেদন করেছিলেন সিএসইর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রয়াত ওয়ালিউল মারুফ মতিন। এ জন্য তিনি কমোডিটি অ্যান্ড ডেরিভেটিভস এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ (সিডিএক্স) নামের একটি কোম্পানিও করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন প্রথম স্বর্ণ লেনদেনের মাধ্যমে এ কমোডিটি এক্সচেঞ্জটির কাজ শুরু করবেন। তখন বাংলাদেশে বৈধ পথে সোনা আমদানির কোনো সুযোগ ছিল না। তিনি সেই কাজটি শুরু করতে চেয়েছিলেন। এ নিয়ে দৌড়ঝাঁপও করেছেন, কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতা পেলেও অনুমোদন পাননি।
একই সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য একটি সমীক্ষাও সম্পন্ন করে। সেখানে ধান, পাট, আলু, চা, চিনি, স্বর্ণ ও রৌপ্যকে কমোডিটি এক্সচেঞ্জের আওতায় আনার কথা বলা হলেও প্রাথমিকভাবে আলু ও পাট নিয়ে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ শুরুর সুপারিশ করা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, এই পণ্য দুটি তুলনামূলকভাবে কম মূল্য স্পর্শকাতর। তদারকির জন্য এসইসিতে একটি বিশেষ বিভাগ খোলারও সুপারিশ করা হয়। তবে বাজার বড় হলে ধীরে ধীরে এসইসি থেকে সরিয়ে আলাদা নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের পক্ষে মত দেওয়া হয়। কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু করতে প্রতিবেদনে সচেতনতার অভাবকে প্রধান বাধা রূপে চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়, বাংলাদেশে তা চালু করার ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকি থাকলেও সুবিধার দিকই বেশি।পণ্য বিনিময় কেন্দ্রে অনেকটা শেয়ারবাজারের মতো বিভিন্ন পণ্য আগাম ভিত্তিতে বেচাকেনা হবে।
তবে এসব দৌড়ঝাঁপ কিছুদিন পরেই থেমে যায়। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার চার মাসের মাথায় বাংলাদেশে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর ব্যাপারে আবারও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কথা বলা হয়। এরপর আট মাস পেরিয়ে গেলেও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ হয়নি। ২০০৯ সালের ১ এপ্রিল জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির ষষ্ঠ বৈঠকে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ গঠন সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের জন্য জাপানের শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের কার্যক্রম পরিদর্শন এবং সেই আলোকে এ দেশে পণ্যসামগ্রীর ভবিষ্যত্ বাজার খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।পরে এসইসির তত্কালীন চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী ওই কমিটিকে জানান, শিকাগো বোর্ড অব ট্রেড এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে রাজি হয়নি। তবে মুম্বাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাড়া পাওয়া গেছে।
এরপর সময় গড়িয়ে ২০১৩ সাল। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমোদন ছাড়াই এই বছর কমোডিটি এক্সচেঞ্জের কার্যক্রম শুরু করে দেশবন্ধু গ্রুপ নামে একটি শিল্পগোষ্ঠি। বাংলাদেশ জুট অ্যান্ড কমোডিটি এক্সচেঞ্জ নামে পণ্য লেনদেনের এই আয়োজনের আইনগত বৈধতা নিয়ে সে সময়েই প্রশ্ন উঠেছে। এরপর বিএসইসির চাপে তারা তাদের নাম থেকে কমোডটিটি এক্সচেঞ্জ শব্দটি প্রত্যাহার করে নেয়।
সেখান থেকে গতবছর ২৮ অক্টোবর দেশের প্রথম কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু করার অনুমতি পায় চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) দেশের দ্বিতীয় শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে (সিএসই) কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর বিষয়ে শর্ত সাপেক্ষে প্রাথমিক সম্মতিপত্র দিয়েছে। এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে ওয়্যারহাউস ও মান ব্যবস্থা নিশ্চিতে অবকাঠামোগত অত্যাবশ্যকীয় শর্ত পরিপালন করা। কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু ও পরিচালনায় এবং পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু করার আগে অবশ্য ৬টি অবকাঠামো সুবিধা এবং সক্ষমতা নিশ্চিত করার কথা জানানো হয়।
অনুমতির সাথে সাথে সিএসইকে বাজারে অংশগ্রহণকারীদের জন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি, ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখতে বলা হয়। এছাড়া মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে পণ্যের যথাযথ তথ্য সংগ্রহ ও সামগ্রিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং কমোডিটি এক্সচেঞ্জ গঠনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত প্রস্তাব দিতেও বলা হয় চিঠিতে।
গত মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠায় ভারতের মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জের (এমসিএক্স) সঙ্গে সিএসইর চুক্তি স্বাক্ষর হয়। দেশে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ গঠনের বিষয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা না থাকায়, ভারতের মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জের কাছ থেকে চুক্তি অনুযায়ী কারিগরি ও পরামর্শক সেবা নেবে সিএসই।