মিজানুর রহমান হৃদয়ঃ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো ইচ্ছা করেই বিনিয়োগকারীদের কোনো ডিভিডেন্ড দিচ্ছে না। আবার যারা দিচ্ছে তাও স্টক ডিভিডেন্ড দিচ্ছে, ফলে কিছুই পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। মুনাফা হওয়া সত্ত্বেও অডিট রিপোর্টে সঠিক চিত্র দেখানো হয়না। বিনিয়োগের বিপরীতে রিটার্ন না পাওয়ায় বাজার ছেড়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। এছাড়াও নানাবিধ কারণে বাজারে দীর্ঘদিনের পতন অব্যাহত ছিল। কিন্তু বর্তমানে নানা উদ্যোগের কারণে বাজার আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাজারের গতিবিধি এবং বিভিন্ন দিক নিয়ে পুঁজিবাজার.ডটকমকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন সাদ সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেন। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ পুঁজিবাজারের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।
শেয়ার বাজারের মূল সমস্যা কোম্পানিতে-অস্বচ্ছ অডিট,
বানানো আর্নিং, সাজানো ইপিএস আর মনগড়া ডিভিডেন্ড
ফলশ্রুতিতে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা
পুঁজিবাজার ডটকম: বর্তমান বাজার পরিস্থিতিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
দেলোয়ার হোসেন: বাজার আরো ভাল হবে বলে আমরা আশাবাদী। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের এখন উপযুক্ত সময়। যারা এখন বিনিয়োগ করবে তারা ভাল কিছু পাবে বলে আমার ধারণা। যারা টিকে আছে এবং টিকে থাকবে তারা গেইন করতে পারবে। বাজারে আস্থার সঙ্কটের কারণে অনেক বিনিয়োগকারী বাজার ছেড়ে চলে গেছেন। বিনিয়োগকারীরা বাজারের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না। এ আস্থার সঙ্কট দূর করতে হবে। গত পাঁচ বছরে মিনিমাম আমার হাউজের প্রায় ২০ হাজার বিও একাউন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। তারা সব হিসাব ক্লোজ করে চলে গেছে। এতে আমার লোকসান হচ্ছে বাজারেও ক্ষতি হচ্ছে। এর মধ্য থেকেই বাজার আবার ঘুরে দাড়ানো শুরু করেছে।সামনের দিনগুলোতে আরো ভাল হবে বলে আমি আশাবাদী। ডিএসইতে যদি গড়ে ৭০০ কোটি টাকার লেনদেন হয় তাহলে আমরা লাভবান হব, সবাই লাভবান হবে।
কোনো কোনো কোম্পানি ইচ্ছে করেই ৪-৫ বছর ধরে নিজেদেরকে মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে রেখে বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড বঞ্চিত করছেন। যেমন আর এন স্পিনিং। কোম্পানিটির প্রত্যেক কোয়াটারে ইপিএস আড়াই থেকে ৩ টাকা হয়। কখনো দেখায় না। শাস্তির বিধান না থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো এমনটা করার সাহস পাচ্ছে।
পুঁজিবাজার ডটকম: এই মুহূর্তে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট দূর করার জন্য কি করনীয় আছে?
দেলোয়ার হোসেন: সবাই লাভের আশায় বিনিয়োগ করে। অনেকে এই পুঁজিবাজারের উপরই নির্ভরশীল। পুঁজিবাজারের আয় দিয়ে তাদের জীবন চলে। আমাদের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা হচ্ছে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে নিয়ে। তারা ভাল আর্নিং করে ভাল প্রোফিটে আছে কিন্তু সেটা সঠিকভাবে দেখায় না। অনেক কোম্পানি আছে ভাল আর্নিং হচ্ছে কিন্তু ডিভিডেন্ড দিচ্ছে না। আবার যারা দিচ্ছে তারা ক্যাশ না দিয়ে স্টক দিচ্ছে, এতে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হচ্ছে না বরং ঠকছে । স্টক দিলে শেয়ারের দর আরো কমে যায়। বিনিয়োগকারীরা কিছুই পায়না। কোম্পানিগুলো এভাবেই বিনিয়োগকারীদের প্রতারণা করে আসছে। আয় বেশি হওয়ার পরও চুরি করে শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) কম দেখাচ্ছে। কোম্পানিগুলো তাদের ইচ্ছামত বানোয়াট অডিট রিপোর্ট দেখাচ্ছে। দেখা গেল একটা কোম্পানির ইপিএস ২ টাকা। সে তার সুবিধামত দেখাল ২০ পয়সা বা ৩০ পয়সা। টোটাল বিষয়টি এমন অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে মনে হচ্ছে বাজারের কোনো অভিভাবক নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থা কি করছেন তা জানি না। কোনো কোনো কোম্পানি মামলা মোকাদ্দমা করে ৪ থেকে ৫ বছর ধরে কোনো ডিভিডেন্ড দিচ্ছে না, ইচ্ছে করেই বিষয়টি ঝুঁলিয়ে রাখছে। যেমন একটা কোম্পানির নাম ধরে বলতে পারি আরএন স্পিনিং। কোম্পানিটি প্রত্যেক কোয়াটারে তাদের ইপিএস আড়াই থেকে ৩ টাকা হয়। কখনো দেখায় না। শাস্তির বিধান না থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো যা ইচ্ছা তাই করতেছে। এ ধরণের অনেক কোম্পানি আছে তাদের আয় সঠিকভাবে দেখায় না। এভাবেই বিনিয়োগকারীদের ঠকানো হচ্ছে। কোম্পানিগুলো বড় বড় গেম্বলারের সাথে যোগসাজস করে শেয়ারের দর নিজেরাই নির্ধারণ করার চেষ্টা করছে। ইপিএস কম দেখিয়ে শেয়ারের দাম কমিয়ে নিজেরা কিনে নেয় পরবর্তীতে আবার ইপিএস বেশি দেখিয়ে নিজেরা বিক্রি করে দেয়। কারণ শেয়ার ব্যবসার সাথে প্রায় প্রতিটি কোম্পানিই জড়িত হয়ে পড়েছে। আমাদের মার্কেটের অধিকাংশ কোম্পানি দুষ্ট গরুর মত। আমার মতে এই দুষ্ট গরুর চেয়ে শূণ্য গোয়াল অনেক ভাল। কোম্পানিগুলো যদি সঠিক আর্নিংস দেখায় এবং স্টক না দিয়ে ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেয় তাহলে বিনিয়োগকারীরা আবার বাজারে আসতে শুরু করবে।
আরেকটি কোম্পানি বীকন ফার্মা। এরা ৪-৫ বছর ধরে লভ্যাংশ দিচ্ছে না। তারা ক্যান্সারের ওষুধ তৈরি করে। এমন কোনো হাসপাতাল বা ফার্মেসী নেই যেখানে বীকন ফার্মার ওষুধ পাওয়া যাবে না। তাদের ওষুধের মানও ভাল। তাদের হিউজ ইনকাম। কিন্তু স্বচ্ছ এবং সঠিক রিপোর্ট তারা প্রকাশ করেন না। ইচ্ছামত ৫ পয়সা, ১০ পয়সা করে ইপিএস দেখায়। অথচ তাদের ইপিএস ৫ থেকে ১০ টাকার নিচে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারা বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো ডিভিডেন্ড দিচ্ছে না। শুধু বিনিয়োগকারীকে ঠকানোর জন্যই কোম্পানিটি এরকম করছে।
পুঁজিবাজার ডটকম: এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কি?
দেলোয়ার হোসেন: অডিট ফার্মগুলোর স্বচ্চতা ও জবাবদিহিতা যদি থাকে, তাহলে তাদের এর আওতায় আনাতে পারলেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। যেমন বীকন ফার্মা ৪-৫ বছর ধরে লভ্যাংশ দিচ্ছে না। তারা ক্যান্সারের ওষুধ তৈরি করে। এমন কোনো হাসপাতাল বা ফার্মেসী নেই যেখানে বীকন ফার্মার ওষুধ পাওয়া যাবে না। তাদের ওষুধের মানও ভাল। তাদের হিউজ পরিমাণ ইনকাম রয়েছে। কিন্তু স্বচ্ছ এবং সঠিক রিপোর্ট তারা প্রকাশ করেন না। তারা ইচ্ছামত ৫ পয়সা ১০ পয়সা করে ইপিএস দেখায়। আমার ধারণা তাদের ইপিএস ৫ থেকে ১০ টাকার নিচে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারা বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো ডিভিডেন্ড দিচ্ছে না। শুধু বিনিয়োগকারীকে ঠকানোর জন্যই ইচ্ছা করে ইপিএস কম দেখাচ্ছে। রিটার্ন না আসলে মানুষ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আসবে কেনো? এজন্য কোম্পানির অডিট রিপোর্ট আরো স্বচ্ছ হওয়া দরকার এবং সঠিক চিত্র তুলে ধরা দরকার। তাহলে শেয়ারের দর কমবে না বরং বাড়বে এবং বিনিয়োগকারীরাও বাজারের প্রতি আগ্রহী হবেন বাজার আরো ভাল হবে আরো গতি পাবে। আর এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।
পুঁজিবাজার ডটকম: যেসব কোম্পানি ভালো করেও বিনিয়োগকারীদের কোনো ডিভিডেন্ড দিচ্ছে না এদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ?
দেলোয়ার হোসেন: পুঁজিবাজারের এই গতিশীলতা ধরে রাখতে হলে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে অবশ্যই স্টক না দিয়ে ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিতে হবে। তাহলে বাজারে বিনিয়োগকারীরা ফিরে আসবে, লেনদেনও বেশি হবে, পাশাপাশি সবাই লাভবান হবে। কেননা কোম্পানিগুলোর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বাজার থেকে ছিটকে পড়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। কারণ বড় বড় কোম্পানিগুলো মুনাফা করার পরও দেখায় তাদের লাভ হয়নি। লাভ হয় নাই তাই বিনিয়োগকারীদের জন্যও কিছু নাই। পাবলিকের টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠান করবে, পাবলিকের টাকা নিয়ে ব্যবসা করবে অথচ ডিভিডেন্ড দিতে পারবে না। ভবিষৎ এ আইপিওতে আসা কোম্পানির ক্ষেত্রে পাবলিক যাতে ইক্যুইজেশন করতে পারে সে বিধান রাখা উচিৎ। কারণ পাবলিক অর্ধেক শেয়ার হোল্ড করে থাকে।
পুঁজিবাজার ডটকম: ২০১০ সালের পর বিএসইসিকে পূর্নগঠন করা হয়েছে এর প্রভাব কি বাজারে পড়েছে?
দেলোয়ার হোসেন: আমার পুঁজিবাজারের বয়স প্রায় অর্ধ শতক ধরে। আর এসইসির বয়স মাত্র ২০ বছর। এ সময়ের মধ্যে বিএসইসি’র অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। তারা দিন দিন ভাল উদ্যোগ নিচ্ছে এবং ভাল করছে এ প্রভাব বাজারে রয়েছে। তারপরও আমি বলব আইপিওতে নতুন কোম্পানী আনার ক্ষেত্রে আরো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। এই এসইসির নেতৃত্বেই মার্কেট আরো ভাল হতে পারে বলে আশা রাখি।
পুঁজিবাজার ডটকম: সামনে ডিবিএ নির্বাচন নতুন নেতৃত্ব আসবে। তাদের কাছে কি প্রত্যাশা করেন। বাজারের উন্নয়ন ও ব্রোকারদের জন্য বর্তমান বোর্ডের ভুমিকা কেমন ছিল?
দেলোয়ার হোসেন: ডিএসই ডিমিউচ্যুয়ালাইজড হয়েছে সেখানে আমাদের ভূমিকা ছিল অন্যতম। যারা ডিবিএ বোর্ডে আছে তারা বাজার উন্নয়নে করনীয় যা ছিল তা-ই তারা করেছে। তারা বিএসইসি ও সরকারের সাথে বাজার উন্নয়নে বিভিন্ন ইস্যুতে বড় ভুমিকা রেখেছেন। আর ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশনের (ডিবিএ) নির্বাচনে আমিও একজন প্রার্থী। নতুন নেতৃত্বে যারা আসবে তারা বাজারের সার্বিক উন্নয়ন এবং ব্রোকারদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভূমিকা রাখবে। আর পুঁজিবাজার ভাল হলে দেশের জিডিপিতে ভাল অবদান রাখবে। আমরাও ভাল থাকব।
পুঁজিবাজার ডটকম: পুঁজিবাজার ডটকমকে সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
দেলোয়ার হোসেন: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।